আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হওয়ার পেছনের গল্প জো বাইডেন

সম্প্রতি বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রে একটি বড় পালাবদলের সাক্ষী হয়ে থাকলো গোটা পৃথিবী। বিশ্বের সবথেকে পুরোনো গণতন্ত্র ও সবথেকে শক্তিশালী দেশ আমেরিকার রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হলেন জো বাইডেন। বর্তমান ও বিদায়ী রাষ্ট্রপতি এবং রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নির্বাচনে হারিয়ে তিনি ডেমোক্র্যাটিক দলের হয়ে নির্বাচিত হলেন বিশ্বের সবথেকে শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রনেতা হিসেবে।

আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হওয়ার পেছনের গল্প জো বাইডেন

জো বাইডেন এর জন্ম হয় ২০শে নভেম্বর ১৯৪২ সালে আমেরিকার পেনসিলভানিয়া রাজ্যের স্ক্র্যান্টন শহরে। তাঁরা ছিলেন তিন ভাই এবং এক বোন। জো বাইডেন এর পরিবার প্রথমদিকে আর্থিক দিক থেকে সচ্ছল থাকলেও পরের দিকে তার পিতা বেশ কিছু আর্থিক জটিলতায় জড়িয়ে পড়ায় তাঁর পরিবার আর্থিক দুর্দশায় পড়েন।

ভিনগ্রহী উপগ্রহ আমাদের ওপরে নজর রাখছেন

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে সেসময়ে দেশে আর্থিক মন্দা দেখা দিয়েছিলো। তাঁর পিতা জোসেফ বাইডেন অনেকদিন কোনো স্থায়ী রোজগার খুঁজে পাননি। ১৯৫৩ সালে জো বাইডেন এর পিতা ডেলাওয়্যার শহরে একটি চাকরি পান ও পুরো পরিবার ডেলাওয়্যার এ স্থানান্তর হয় যায়। যদিও পরের দিকে তিনি একজন পুরোনো গাড়ি ক্রয় বিক্রয় করার সফল ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে পেরেছিলেন।

জো বাইডেনের ছোট বেলা

ছোট বেলায় জো বাইডেন তোতলামির সমস্যায় ভুগতেন যার জন্যে তাঁর স্কুল ও আশেপাশের বাচ্চারা তাঁকে নিয়ে হাসি তামাশা করতো যা কিনা তিনি মোটেই পছন্দ করতেন না। পরে তাঁর ২০ বছর বয়স নাগাদ এই সমস্যাটি তিনি অনেক পরিশ্রম করে কাটিয়ে উঠেছিলেন| তিনি বহুক্ষণ ধরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কবিতা আবৃত্তি করতে থাকতেন। হাই স্কুল এ পড়তে তিনি স্কুল এর ফুটবল এবং বেসবল টিম এ খেলতেন।

পড়াশুনোতে তিনি খুব একটা উজ্জ্বল ছাত্র ছিলেননা কিন্তু ছোটবেলা থেকে তাঁর মধ্যে নেতৃত্ব করবার মতো প্রতিভা বিদ্যমান ছিল। তিনি হাই স্কুল এ সবসময় ক্লাস প্রেসিডেন্ট থাকতেন। ১৯৬১ সালে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির থেকে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন জন এফ কেনেডি। জো বাইডেন তখন কলেজে পড়তেন ও তিনি তখন থেকেই এই ঘটনায় অনুপ্রাণিত হয়ে রাজনীতির প্রতি আগ্রহী হন।

১৯৬৫ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ ডেলাওয়্যার থেকে ব্যাচেলর অফ আর্টস ডিগ্রী নিয়ে গ্রাজুয়েট হন। কিন্তু সেখানেও তাঁর পরীক্ষার ফলাফল ছিল খুবই খারাপ। এর পরবর্তী বছরেই ১৯৬৬ সালে তিনি নেলিয়া হান্টার এর সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এরপর বাইডেন দম্পতি তিন সন্তানের পিতা মাতা হন। তাঁদের দুইটি পুত্রসন্তান ও এক কন্যাসন্তান জন্ম নেয়।

বাইডেনের জীবন

বাইডেন তার জীবন সম্পর্কে বলেন, “আমার প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত সবকিছু ঘটছিল।” ১৯৬৮ সালে তিনি Syracuse University College of Law থেকে আইন পাশ করেন ও এরপর তিনি আইনজীবী হিসেবে প্রাইভেট প্রাকটিস শুরু করেন। ১৯৭২ সালে ২৯ বছর বয়সে ডেলাওয়্যার ডেমোক্র্যাটিক পার্টি থেকে বাইডেন তাঁর এলাকার তৎকালীন রিপাবলিকান সিনেটর এর বিরুদ্ধে নির্বাচনে দাঁড়ান।

বিপক্ষ প্রার্থী খুবই মজবুত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ত্ব হওয়ায় জনতা তাঁকে প্রাথমিকভাবে দুর্বল প্রার্থী হিসেবেই ভেবে নিয়েছিল। জো বাইডেন এর হয়ে অক্লান্ত ভাবে প্রচার চালান তাঁরই পরিবারের সদস্যরা। তাঁর বোন, ভ্যালারি বাইডেন এবং তার বাবা মা দুজনেই প্রতিদিন প্রচার করেছিলেন। নভেম্বর এ ভোটগ্রহণের পর ভোটগণনা পর্যায়ে দুই প্রতিযোগীর মধ্যেই খুব কঠিন প্রতিযোগিতা হয়।

চীনের বিজ্ঞানী দ্বারা তৈরিকৃত ‘কৃত্রিম সূর্যের’ ব্যবহার ও তৈরির ইতিহাস

তা সত্বেও জো বাইডেন বিজয় অর্জন করে দেশের ইতিহাসে পঞ্চম সর্বকনিষ্ঠ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর হয়েছিলেন। এর পরই এই বছরেই ডিসেম্বরে খ্রিস্টমাস এর এক সপ্তাহ আগে বাইডেন এর জীবনে সেই চরম বিপর্যয়টি ঘটে যা তাঁর কাছে সবথেকে বড় দুঃস্বপ্ন ছিল।

বাইডেন এর স্ত্রী তাঁদের সন্তানদের নিয়ে যখন খ্রিষ্টমাস এর শপিং সেরে ফিরছিলেন তখন সেই গাড়িতে এসে ধাক্কা মারে একটি বড় ট্রাক। ঘটনাস্থলে মৃত্যু ঘটে তাঁর স্ত্রীর ও তাঁর এক বছর বয়সী কন্যাসন্তান এর। তাঁদের দুই পুত্রসন্তান ভালোভাবেই জখম ছিল।

বাইডেনের জীবনের ভয়াবহ ঘটনা

বাইডেন তাঁর নিজের জীবনের এই ভয়াবহ ঘটনার ব্যাপারে বলেন, “আমি এটা বুঝতে পারছিলাম যে হতাশা কিভাবে কোনো মানুষকে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিতে পারে। তখন আমার মনে হয়েছিল যেন আত্মহত্যাই একমাত্র সঠিক রাস্তা খোলা ছিল। যেন ঈশ্বর আমার সাথে ভয়ানক ছলনা করলেন।” দুই পুত্রসন্তান আহত হলেও তারা সুস্থ হয়ে উঠেছিল।

বাইডেন চাইতেন সিনেটর এর চাকরি ছেড়ে সম্পূর্ণভাবে নিজের দুই সন্তানের যত্ন নিতে যাতে তারা সুস্থ হয়ে ওঠে। সে সময় সিনেট মাইক ম্যান্সফিল্ড তাঁকে পদ ছাড়তে বাধা দিয়েছিলেন ও তাকে পরামর্শ দেন যাতে কাজের সাথে সাথে দুই সন্তানের দেখাশোনা চালিয়ে যেতে পারেন। জীবনের এই কঠিন সময়ে হার না মেনে নিজের কর্তব্যের কথা মাথায় রেখে এগিয়ে যান ও নিজের লড়াকু মানসিকতার পরিচয় দেন বাইডেন।

বাইডেনের দ্বিতীয় বিবাহ

১৯৭৭ সালে তিনি তার দ্বিতীয় স্ত্রী জিল বাইডেনের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তাঁদের কন্যাসন্তান অ্যাশলে ১৯৮১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৭৩ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত, বাইডেন নিজের সিনেট ক্যারিয়ারে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছিলেন। সিনেটে থাকাকালীন বাইডেন বেশ কয়েক বছর ধরে বৈদেশিক নীতি কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করে অন্যতম শীর্ষস্থানীয় বিদেশ নীতি বিশেষজ্ঞ হিসাবে সম্মান অর্জন করেছিলেন।

তাঁর বহু বৈদেশিক নীতি অবস্থানের মধ্যে রয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে কিছু চুক্তি, বাল্কানসে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি, ন্যাটোতে প্রাক্তন সোভিয়েত ব্লক দেশগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা এবং প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধের বিরোধিতা করা। ১৯৮৭ সালে, নিজেকে ওয়াশিংটনের অন্যতম প্রধান গণতান্ত্রিক সংসদ সদস্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার পরে, তিনি আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

স্মার্টফোনের ইতিহাস আর উদ্ভাবনে স্টিভ জবসের অবদান

যদিও কিছু কারণের জন্যে তিনি সেসময় প্রার্থী হিসেবে বাদ পড়েন। প্রচারাভিযানের সময় মারাত্মক মাথাব্যথায় ভুগছিলেন এবং ১৯৮৮ সালে তিনি বাদ পড়ার কিছু দিন পরে মেডিকেল চেক আপ হলে ডাক্তার বলেন যে তাঁর দুটি মস্তিষ্ক অ্যানিউরিজম রয়েছে। এবং খুব তাড়াতড়ি অস্ত্রোপচার না হলে হতে পারে প্রাণঘাতী। পরবর্তীকালে মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারের দরুন তার ফুসফুসে রক্ত জমাট বাঁধে।

যার ফলস্বরূপ তাঁর আরও একটি অস্ত্রোপচার হয়। দীর্ঘ সাতমাস একরকম স্থিতিশীল অবস্থায় থাকার পর সুস্থ হয়ে আবার সিনেটে ফিরে আসেন। বৈদেশিক নীতি ছাড়াও বাইডেন কঠোর অপরাধ আইন প্রণয়ন করার একজন দৃঢ় সমর্থক ছিলেন। বাইডেন ছিলেন তখন সেনেট জুডিশিয়ারি কমিটির চেয়ারম্যান।

অতিরিক্ত পুলিশকর্মী নিয়োগ

১৯৯৪ সালে কঠোর ভাবে আইন প্রণয়ন করার জন্যে তিনি আইনব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন আনেন ও ১০০০০০ অতিরিক্ত পুলিশকর্মী নিয়োগ করা হয়। পরবর্তী বছরগুলিতে তিনি দারফুরে গণহত্যার অবসান ঘটাতে আমেরিকান পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানিয়েছিলেন।

রাষ্ট্রপতি জর্জ ডব্লু বুশের ইরাক যুদ্ধ পরিচালনার বিরুদ্ধে, বিশেষত ২০০৭ সালে ইরাকে সৈন্যবাহিনীর বৃদ্ধির তীব্র বিরোধিতা করে বক্তব্য রেখেছিলেন। প্রথম বারের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হবার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার প্রায় ২০ বছর পর ২০০৭ সালে বাইডেন আরেকবার চেষ্টা করেছিলেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির থেকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে মনোনীত হতে।

কিন্তু এইবারে বারাক ওবামা ও হিলারি ক্লিনটনের সামনে জো বাইডেন খুবই ফিকে হয়ে গেলেন। বারাক ওবামা সেবছর ডেমোক্র্যাটিক পার্টির তরফ থেকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন। জো বাইডেন এই নির্বাচনের লড়াইয়ে হয়ে গেলেন বারাক ওবামার ছায়াসঙ্গী। ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে জো বাইডেন ও বারাক ওবামা নিজেদের কেন্দ্র থেকে বিজয়ী হন। এবং এই ভোট এ ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বিজয়ী হয়।

আমেরিকার ৪৭ তম রাষ্ট্রপতি

আমেরিকার ৪৪ তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে বারাক ওবামা ও ৪৬ তম উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে জো বাইডেন শপথ নেন। এইসময় তিনি রাষ্ট্রপতির প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি ওবামা প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলির ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিলেন যা তাঁর অভিজ্ঞতাকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেছে। ২০১২ সালে আরেকবার ডেমোক্র্যাটিক পার্টি বিজয়ী হয়।

বারাক ওবামা ও জো বাইডেন দ্বিতীয়বারের জন্যে আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। ২০১৫ সালে জো বাইডেন এর ব্যক্তিগত জীবনে আরেকটি বড় ক্ষতির সম্মুখীন হন। তাঁর পুত্র বিউ বাইডেন ব্রেন ক্যান্সার এ আক্রান্ত হয়ে মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মারা যান।

বিউ বাইডেন নিজেও একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ছিলেন ও ডেলাওয়্যার শহরে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। এই ঘটনার পর জো বাইডেন হোয়াইট হাউসে একটি অনুষ্ঠানে ঘোষণা করেন যে ২০১৬ সালের নির্বাচনে তিনি আর কোনো পদের জন্যে প্রার্থী হতে চাননা কিন্তু তিনি রাজনেতা হিসেবে ডেমোক্রেটিক পার্টির হয়ে নিজের দ্বায়িত্ব ও কার্য করে যাবেন।

ওবামা ও জো বাইডেনের চমক

১২ জানুয়ারী ২০১৭ সালে বারাক ওবামার রাষ্ট্রপতি কার্যকালের শেষ দিকে ওবামা, জো বাইডেন কে চমকে দিয়ে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন ও বাইডেনকে Presidential Medal of Freedom with distinction এ সম্মানিত করেন। যা কিনা আমেরিকার সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান। রাষ্ট্রপতি ওবামা, জো বাইডেনকে সর্বকালের সেরা উপরাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা করেন।

২০১৭ সালে ২০ জানুয়ারি রিপাবলিকান পার্টির থেকে নির্বাচিত হয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ৪৫ তম মার্কিন রাষ্ট্রপতির পদে বসেন। জো বাইডেন এই সময়ে বিরোধী নেতা হিসেবের সরকারের সমালোচনা ও বিরোধিতা করতে থাকেন। ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল বাইডেন একটি বক্তব্যে স্পষ্ট করেন যে তিনি ২০২০ নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির থেকে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচনী লড়াই লড়তে চলেছেন।

৩ নভেম্বর ২০২০ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা হওয়ার সাথে সাথে এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে ডেমোক্রেটিক পার্টি বিজয়ী হতে চলেছে। জো বাইডেন হতে চলেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬ তম রাষ্ট্রপতি। এক বালক যে কিনা দুর্বল মেধার ছাত্র ছিল, যে কিনা তোতলামির সমস্যা ভুগতো, সেই আজ নিজের সমস্ত বাধাকে অতিক্রম করে হতে চলেছেন পৃথিবীর সবথেকে শক্তিশালী দেশের রাষ্ট্রপতি।

জো বাইডেন এর জীবনী সমস্ত সাধারণ মানুষের কাছে সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক। আর্টিকেলটি ভালো লাগলে শেয়ার আপনার বন্ধুকেও জানার সুজুক করে দিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *