জীবন যেখানে যেমন, পৃথিবী সেখানে তেমন

যেদিন ক্লাসের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়েটা সবার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলো,আমি নাকি তাঁর বুকে হাত দিয়েছিলাম,তাকে নষ্ট করতে চেয়েছিলাম। সেদিন সবাই আমার দিকে অনেক ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে ছিলো। ক্লাসের প্রায় আশি জন ছাত্র-ছাত্রী সবাই আমাকে খারাপ ভেবেছিলো। সবাই মেয়েটার কান্না ভেজা কণ্ঠটা বিশ্বাস করেছিলো।

আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটাও সেদিন আমার থেকে দূরে সরে গিয়েছিলো। আমার সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষকটা আমার গালে চড় মেরে বলেছিলো, “তুমি অনেক ভালো ছাত্র। আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসতাম। কিন্তু তুমি আজকে যেই কাজটা করেছো তার জন্য আমার ভালোবাসাটা তোমার জন্য চিরতরে শেষ হয়ে গিয়েছে।

জীবন যেখানে যেমন

নিজেকে একজন ভালো মানুষ হিসেবে যে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে না সে যতোই ভালো ছাত্র হোক,টাকার মালিক হোক এসবে কিছু যায় আসে না। একজন মানুষের সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো সে একজন মানুষ। তবে তোমার মতো মানুষ না। তুমি এখনো মানুষ হতে পারোনি। যদি পারো মানুষ হয়ে দেখাও।

সেদিন আমি ক্লাসের কারো দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারেনি। কোনো অপরাধ না করেও নিজেকে অনেক বড় অপরাধী মনে হয়েছিলো। আমার দুঃখটা সেদিন কারো সাথে শেয়ার করতে পারিনি। ক্লাসে যতটুকু সময় ছিলাম ততোটুকু সময় আমি নিচের দিকে তাকিয়ে শুধু চোখের পানি ফেলেছিলাম। সেদিন আমি বুঝেছিলাম চোখের পানিরও দাম কম আর বেশি হয়।

কারণ মেয়েটার চোখের পানি দেখে সবাই অনেক ইমোশনাল হয়ে গিয়েছিলো,আমি মেয়েটার সাথে এসব করেছি কিনা সেটা না জেনেই সবাই মেয়েটার জলভরা চোখ দেখে তাঁর কথা বিশ্বাস করেছিলো। কিন্তু আমার চোখের পানিটা কাউকে আবেগী করতে পারেনি। আমার মতোই আমার চোখের পানিটাও কম দামী।

ক্লাস থেকে চলে আসার সময় ওই মেয়েটার সাথেই আমি কথা বলি। যে মেয়েটা সবার সামনে আমাকে এভাবে খারাপ একটা ছেলে হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। আমি তাঁর কাছে গিয়ে তাকে কিছু কথা বলি। “তুমি এমনটা না করলেও পারতে। তুমি হয়তো ভেবেছিলে এমনটা করার পর আমি তোমার সম্পর্কে কোনো কিছু বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। সবাই ভাববে তোমার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তোমার সম্পর্কে খারাপ কথা বলছি।

মানুষটা আমাকে সবার সামনে

কিন্তু তুমি হয়তো জানো না তুমি এসব না করলেও আমি তোমার সম্পর্কে কারো কাছে কিছু বলতাম না। তবে ভয় পেয়ো না এখনও তোমার সম্পর্কে কারো কাছে কিছু বলবো না। যে মানুষটা আমাকে সবার সামনে খারাপ বানিয়েছে,আমি তাকে সবার সামনে খারাপ বানাতে চাই না।

কলেজ থেকে বাসায় যাওয়ার পথে যখন দেখলাম সবাই আমার দিকে কেমন করে যেনো তাকিয়ে আছে। তখন আমার বুঝতে অসুবিধা হলো না,আমার খবরটা এলাকার অনেকেই জেনে গিয়েছে। তাই তারা আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছে। এসব খবর বাতাসের মাধ্যমে ছড়িয়ে যায়। আমারটাও হয়তো সেভাবেই সবার কাছে পৌছে গিয়েছে। হয়তো বা বাড়িতেও জেনে গিয়েছে।

এমনিতেই মা আমার দোষ খোঁজেন সবসময়। একটু ভুল পেলেই বাড়ি থেকে বের করে দিতে চান। শুধু বাবা বলে কয়ে হয়তো আমাকে বাড়ির এককোণে ছোট্ট একটা রুম দিয়ে রেখে দিয়েছেন। মা চায় না আমি এই বাড়িতে থাকি।

যখন বাসায় গেলাম তখন দেখলাম মা আর বাবা দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দেখে বুঝতে পারলাম কলেজের ঘটনাটা তারা জেনে গিয়েছে। তখন আর দেরি না করে আমি বাবাকে বললাম, “আমি কিছু করিনি বাবা,বিশ্বাস করেন। আমার মৃত মায়ের কসম বাবা আমি কিছু করিনি।

মেয়েটা তোর সম্পর্কে এসব

তুই যদি কিছু নাই করবি তাহলে মেয়েটা তোর সম্পর্কে এসব বলবে কেনো? তোর ক্লাসে তো আরও অনেক সুন্দর সুন্দর ছেলে আছে তাদের সম্পর্কে তো এরকম বলল না, তোর সম্পর্কে কেনো বলল? তুই এসব করেছিস বলেই সে সবার সামনে এসব বলেছে। একটা মেয়ে কখনো নিজের মানসম্মান নিয়ে এরকম মিথ্যা বলবে না। মিথ্যা তো তুই বলছিস এখন আমাদের সাথে।

আমার সৎ মা যখন কথাগুলো বলল তখন আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কি বলবো কিছু বুঝতে পারছিলাম না। তবে এটা বুঝতে পেরেছিলাম যাই বলি না কেনো আমার কথা কেউ এখন বিশ্বাস করবে না। হঠাৎ করেই মা বাবাকে যে কথাগুলো বলল সেই কথাগুলো শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।

“তুমি তোমার ছেলেকে বাড়িতে রাখলে আমি থাকবো না এই বাড়িতে। আমি কোনো ধর্ষককে এই বাড়িতে রাখতে চাই না। আমার একটা মেয়ে আছে, আমি আছি। আমরা তো ওর আপন কেউ না। আমি তো আর ওর আপন মা না,হাবিবাও তো আর ওর আপন বোন না। সুযোগ পেলে কি না কি করে বসবে কে জানে। তুমি ওকে বাড়ি থেকে বের করে দাও।

মা যখন বাবাকে কথাগুলো বলল তখন আমার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। আমি ভাবতাম সৎ মা হলেও একদিন আমাকে ঠিকই নিজের মায়ের মতো আদর করবে। আমি সবসময় আমার সৎ মায়ের মন জয় করার চেষ্টা করেছি কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছি। তবে কোনোদিন ভাবিনি আমার সম্পর্কে এতোটা খারাপ ধারণা জন্ম নিবে তাঁর মনে। নিজেকে পৃৃথিবীর সবচাইতে অপবিত্র মানুষ মনে হচ্ছে।

জানা সত্ত্বেও আমি সেখান থেকে

লজ্জায়,অপমানে সেদিন আমি তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারিনি। এই বাড়ি ছাড়া কোথায় যাবো আমি সেটা না জানা সত্ত্বেও আমি সেখান থেকে কাঁদতে কাঁদতে চলে আসি। আমার বাবা একটিবারের জন্যও আমাকে থাকতে বলেনি। সেদিন আমি খুব করে বুঝেছিলাম আমাদের বাবা ছেলের সম্পর্কটা হয়তো শেষ হতে চলেছে।

এটাও বুঝতে পেরেছিলাম এই বাড়িতে হয়তো আর কোনোদিন আমার জায়গা হবে না। আমাকে চলে যেতে হবে অজানা অচেনা কোনো এক নতুন ঠিকানায়। আমার কাছের মানুষগুলো আমাকে বুঝতে পারেনি। ভুল বুঝে দূরে ঠেলে দিয়েছে। এখন একজন মানুষই আছে যে মানুষটা আমার শেষ ভরসা। যে মানুষটাকে আমি অনেক বিশ্বাস করি,অনেক ভালোবাসি।

ধৈর্য নয়, বরং নিজের অভ্যাস ও নিজে বদলে যান

আমাদের ওপরে নজর রাখছে ভিনগ্রহের উপগ্রহ

প্রবল ইচ্ছাশক্তি নিয়ে ছুটতে হবে স্বপ্নের পিছুপিছু এ পি জে আব্দুল কালাম

সে মানুষটাও আমাকে অনেক বিশ্বাস করে,ভালোবাসে। তবে কেনো জানি ভয় হচ্ছে। আর সবার মতোই কি সেও আমাকে খারাপ ভাববে,আমাকে বিশ্বাস করবে না? অনেক প্রশ্নের উত্তর থেকেই যাচ্ছে। তাঁর সাথে দেখা না হওয়া পর্যন্ত এসব প্রশ্নের উত্তর আমি পাবো না জানি। তবুও কেনো জানি প্রশ্নগুলো নিয়ে ভাবতে ইচ্ছে করছে।

সেদিন রাতটা আমি সিয়াম নামের এক বন্ধুর বাসায় তাঁর সাথেই থাকি। ও হয়তো বিশ্বাস করেছিলো আমি এসব করিনি। আমি এতোটা খারাপ মানুষ না যে একটা সুন্দরী মেয়ের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে তাঁর বুকে হাত দিবো,কিংবা কে জানে? হয়তো বা বিশ্বাসও করেছিলো। ভদ্রতার খাতিরে বলতে পারেনি।

মানুষই বলতে পারে না

কারণ কিছু কিছু কথা থাকে যেগুলো অনেক সময় মানসম্মান কিংবা ভদ্রতার খাতিরে বলা যায় না। বিপরীত পাশের মানুষটার অবস্থার কথা চিন্তা করে অনেক মানুষই বলতে পারে না। আবার কিছু মানুষ থাকে যারা বিপরীত পাশের মানুষটা কথা চিন্তা করে না,একবারও ভাবে না কথাগুলো বললে তাঁর অবস্থাটা কি হবে।

সেদিন সিয়ামের ওখান থেকেই আমি আদিবার সাথে ফোনে কথা বলি। তাকে বিকেল তিনটার সময় আমার সাথে দেখা করতে বলি। সেও ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় চলে আসবে বলে ফোনটা রেখে দেয়। আমিও ঘুমানোর বৃথা চেষ্টা করে বিছানায় গা এলিয়ে দেই। তবে সেদিন রাতটা আমার নির্ঘুম কাঁটে। সেদিন ছিলো শুক্রবার। সিয়ামের সাথেই জুমার নামাজটা পড়ে ওর বাসায় দুপুরে খেয়ে ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসি।

“আমি তোর প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ। একটা রাত আমাকে থাকতে দিয়ে অনেক উপকার করলি।” এই কথাগুলো বলে আমি সিয়ামের ওখান থেকে আদিবার সাথে দেখা করার জন্য চলে যাই। আদিবার সাথে দেখা করতে গিয়ে যা দেখলাম সেটা নিজের চোখকে বিশ্বাস করাতে পারলাম না। কারণ আদিবা আজ একা আসেনি,তাঁর সাথে সে একটা মেয়েকে নিয়ে এসেছে।

তাঁর সাথে যে মেয়েটা এখন দাঁড়িয়ে আছে সেই মেয়েটাই ক্লাসে সবার সামনে আমাকে অপমান করেছিলো,খারাপ বানিয়েছিলো। আমি বুঝতে পারলাম না আদিবার সাথে মেয়েটার কি সম্পর্ক। আদিবার কোনো কাজিন নাকি বান্ধবী?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *